Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব

শাহ আবদুর রউফ

শাহ আবদুর রউফ ১৮৮৯ সালে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার মকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শাহ কলিমউদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন একজন  বিশিষ্ট  পুঁথিকার । যোগ্য পিতার যোগ্য সমত্মান শাহ আবদুর রউফ। তিনিও সাহিত্যপ্রতিভার অধিকারী ছিলেন। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে সুদীর্ঘকাল রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকলেও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে তিনি সর্ম্পকরহিত ছিলেন না।তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন রংপুওে ।এরপর উচ্চশিক্ষাগ্রহণের জন্য তিনি আলীগড়ে গমন করেন। আলীগড় কলেজ থেকে প্রথমে তিনি বি. এ. এবং পরে বি. এল. ডিগ্রী অর্জন করেন। রংপুর সদও ও নীলফামারী মহকুমার মুসলামান ভোটদাতাগণের ভোটে তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য (এম. এল.সি) নির্বাচিত হন।

শাহ আবদুর রউফের দ্বিতীয় কর্মক্ষেত্র রংপুর জেলাবোর্ড। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে রংপুর জেলাবোর্ডের সদস্য হওয়ার সুযোগ তিনি প্রথম লাভ করেন।

শাহ আবদুর রউফ শুধু রাজনীতি, সমাজসেবা এবং শিক্ষার প্রচার ও প্রসাওে তাঁর বহুমুখী প্রতিভাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি নিজে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত ছিলেন এবং সাহিত্যচর্চায় তিনি পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন। তাঁর রচিত ‘‘চতুর্দশী’’ নামে একটি কাব্য ও ‘‘আমার কর্মজীবন নামে দুই খন্ডের একটি গদ্যপুসিত্মকার সন্ধান পাওয়া গেছে।তাঁর রচিত ‘‘চর্তুদশী ’’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল জুন,১৯৬৭ সাল।হজরত মাওলানা শাহ আফতাবুজ্জামান ‘‘বরকতের নূর’’ ও ‘‘নাতে রসূল মকবুল’’ গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হয়েছিল।এভাবে শাহ আবদুর রউফ ধর্মচর্চা ,রাজনীতি , সমাজসেবা , শিক্ষা বিস্তারও সাহিত্যচর্চায় অবদান সুচিহ্নিত করেছেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী গণ অভুত্থানের পূর্বে ঐ বছরের ১লা জানুয়ারী তারিখে রংপুর শহরের নিজ বাসভবনে তিনি ইমেত্মকাল করেন।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রহ:)

মাওলানা কারামত আলী ১৮০০ সালের ১২ই জুন উত্তর প্রদেশের অমর্ত্মগত জৌনপুর শহরের মোলস্নাটোলা মহলস্নায় জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম আবু ইবরাহীম শেখ ইমাম বখশ। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ আলেম। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর নিত্যসহচর ও খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলীফা হযরত আবুবকর (রাঃ) এর ৩৫তম অধসত্মন পুরম্নষ হবার গৌরব তিনি অর্জন করেছেন।

কৃতিত্বপূর্ণ অবদানঃ তাঁর রচিত বহুল প্রচলিত গ্রন্থ ‘‘মিফতাহুল জান্নাত’’ ও ‘‘রাহে নাজাত’’। তাঁর রচিত অন্যান্য উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থ ‘‘কওলুল আমীন’’,‘‘মুরাদুল মুরীদীন’’,যীনাতুল কবারী’’,‘‘মাখারেজুল হুরূফ ’’,‘‘কাওলুল হক’’‘‘মেরাআতুল হক’’,‘‘হক্কুল ইয়াকীন’’,রাহাতে রূহ’’,‘‘কুওয়াতুল ঈমান’’, ‘‘লুজ্জায়ে ফাতায়া’’,‘‘ফয়েজে আম’’, ‘‘খায়রম্নল বারিয়্যা’’,‘‘রিসালায়ে ফায়েছেলা’’ ,‘‘ওয়াক্কাতুল মমীনীন’’, ‘‘দাওয়াতে মসনুলা’’, ‘‘কেয়ামাতুল হারামাঈন’’প্রভৃতি।কারামত আলী জৌনপুরী ১৮৭৩ সালের মে (১২৯০ হিজরী, রবিউস সানী) জুমআর দিন সুবেহ সাদিকের ওয়াক্তে রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ার বাসভবনে ইমেত্মকাল করেন।মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর (রহ:) ওফাত প্রাপ্তির মাত্র একমাস পর তাঁর স্ত্রী (মওলানা আবদুল আউয়ালের আম্মা ) রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ার বাসভবনে ইমেত্মকাল করেন। মহা সম্মানিত ব্যক্তিত্বদ্বয় স্বামী স্ত্রীকে পাশাপাশি সমাহিত করা হয়েছে। তাঁদেও মাযারের ওপরে গড়ে উঠেছে সর্ববৃহৎ মনোরম মসজিদ ‘‘কারামতিয়া জামে মসজিদ’’ নামে তাঁদেও পবিত্র স্মৃতি বহন করছে। তাঁর ওফাত লাভের ১০ বছর পর পবিত্র সমাধির পাশে প্রথমে টিনের ছাউনীযুক্ত মসজিদ পরে ১৮৯০-৯৯ সালের মধ্যে সৌন্দর্যমন্ডিত পাকা ভবন (মসজিদ)নির্মিত হয়। যা পরবর্তীকালে একাধিকবার সম্প্রসারণ করার দরম্নণ বিশাল আয়তাকার মসজিদে পরিণত হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।

 

বেগম রোকেয়া 

বেগম রোকেয়া উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ১৮৮০ সালের ৯ডিসেম্বরও রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ও মাতার নাম রাহাতুন্নেসা চোধুরাণী বেগম রোকেয়ার পিতা ছিলেন পায়রাবন্দের জমিদাররি সর্বশেষ উত্তরাধিকারী।তাঁর মাতা ছিলেন টাঙ্গাইলের বলিয়াদিও জমিদার পরিবারের কন্যা।

বেগম রোকেয়া রচিত সাহিত্য পরিমাণে বিপুল না হলেও বৈচিত্র্যে ভরপুর ।তাঁর গ্রন্থগুলোর নাম মতিচুর (১ম ও ২য় খন্ড), Sultana`s Dream (সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ ও অবরোধবাসিনী। মতিচুর (১ম খন্ড ) প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে ঐ একই বছরে তিনি রচনা করেন Sultana`s Dream প্রথম সংস্করণ ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ।মতিচুর (১ম খন্ড) প্রকাশের ষোল  বছর পওে ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় মতিচুর (২য় খন্ড)। এছাড়া প্রসিদ্ধ ইংরেজ লেখিকা মেরী করেলীর Murder of Delicin নামক উপন্যাসের মর্মানুবাদ করে তিনি রচনা করেন ‘ডেলিসিয়া হত্যা’।

বেগম রোকেয়া কবিত্ব প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। সংখ্যায় কম হলেও তিনি উন্নতমানের কয়েকটি কবিতাও রচনা করেছেন। তিনি যে সমসত্ম কবিতা রচনা করেছিলেন তার মধ্যে বাসিফুল শশধর, নলিনী ও কুমুদ, কাঞ্চনজঙঘা , সওগাত, আপীল নিরূপম বীর, চাঁদ (পদ্মরাগ উপন্যাসের অমর্ত্মগত ) প্রভৃতি  কবিতার নাম জানতে পারা গেছে।

রোকেয়া রচনাবলীতে ষোলটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে । এই সমসত্ম প্রবন্ধের ঈদ সম্মিলন , সিসেম ফাঁক, এন্ডি শিল্প, বঙ্গীয় নারীশিক্ষাসমিতি , লুকানো রতন, রাণী ভিখারিণী, উন্নতির পথে , সবেহ সাদেক, ‘ধ্বংসের  পথে বঙ্গীয়  মুসলিম’  প্রভৃতি উলেস্নখযোগ্য।মৃত্যুবরণের পূর্ব রাত্রিতেও তাঁর লেখনী ছিল সক্রিয়। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তাঁর শক্তিশালী লেখনী থেকে নির্গত  হয়েছে তার শেষ লেখা ‘‘নারীর অধিকার’’।

১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বও ভোর রাতে বেগম রোকেয়া ইমেত্মকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স শহিয়েছিল মাত্র ৫২ বায়ান্ন বছর।

কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস

কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ায় ১৯০১ সালের ২১শে সেপ্টেম্বও কাজী পরিবাওে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর  পিতার নাম কাজী মোহাম্মদ সৈয়দ ও মাতার নাম কামরম্নননেসা বেগম।তাঁর পিতামহের নাম কাজী মোহাম্মদ সামী। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয় ছিলেন।তবে ভাইদের মধ্যে তিনিই প্রথম । তাঁর পূর্বপুরম্নষের বসবাস কোথায় ছিল তা জানা যায়না।তবে ধারণা করা হয় ,নবাবী আমলে তাঁর পিতামহ সরকার ঘোড়াঘাট রঙ্গপুরের কাজী হিসেবে মাহিগঞ্জের পূর্বদিকে নবদিগঞ্জে বসবাস করেছিলেন। ১৮৮০ সালের দিকে তাঁর পিতা কাজী মোহাম্মদ সৈয়দ রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় চলে আসেন। তিনি দেওয়ানি আদালতে চাকরি করতেন। তিনি দেওয়ানি আদালতের সেরেসত্মাদার পদে তিনি উন্নীত হন।

আইন পেশায় নিয়োজিত ছাড়াও কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস ছিলেন একজন সংগঠনপ্রিয় ও নাট্যামোদী। ছাত্রাবস্থা থেকেই নাটকে অভিনয় করতেন তিনি। কারমাইকেল কলেজ ও বর্ধমানের বহরমপুর কলেজে অধ্যয়নকালে নাটকে তিনি অভিনয় করেছে।১৯২৫সালে বহরমপুর কলেজে নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘‘পরপারে’’ নাটকে তিনি অভিনয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন।এই নাটকে ‘‘দাদা মশাই’’ চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেন।সে সময় তিনি পরিচিত হন খ্যাতিমান অনেক নাট্যব্যক্তিত্বেও সাথে।তাঁদের মধ্যে তুলসী লাহিড়ী ডা: জিতেন সোম, প্রবোধচন্দ্র মুখার্জী, ললিত প্রামাণিক, গিরীণ ঘোষ, রেখা চ্যাটার্জী, আবদুল মান্নান চৌধুরী প্রমুখ। আরও জানা যায় ,ডঃ মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও বিদ্রোহীকবি কাজী নজরম্নল ইসলামের সাথে কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াসের পরিচয় ছিল।

সংস্কৃতিচর্চায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে ১৯৮৮ সালে রংপুর পৌরসভা কর্তৃক তিনি সংবর্ধিত হয়েছেন। ১৯৮৯ সালে রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রংপুর শিল্প ভবনের পক্ষে (অধুনা রংপুর শিল্পকলা একাডেমী) কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াসকে স্বর্ণপদক প্রদান করেন। রংপুরের সম্ভ্রমত্ম কাজী পরিবারের কৃতিসমত্মান কাজী মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি একাধারে সংস্কৃতিসেবী । তিনি ১৯৯৪ সালের ১৪ই এপ্রিলে ইমেত্মকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর।

আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম

আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েম ১৯১৬ সালের ১ শে মার্চ রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় এক সম্ভ্রামত্ম মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন্ তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও মাতার নাম সৈয়দা রাবেয়া খাতুন।তাঁর মাতামহের নাম সৈয়দ আবুল ফাত্তাহ।তিনি রঙ্গপুর মোহামেডান এসোসিয়েশনের প্রথমে সম্পাদক  এবং পরবর্তী সময়ে সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১৯৪৭ সালে পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার পর তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।আইনপেশায় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।তিনি ছিলেন একজন সফল আইনজীবী। ১৯৭৪ সালে নয়াদিলস্নীতে অনুষ্ঠিত আমত্মর্জাতিক  আইনজীবী সমিতির সম্মেলনে তিনি অংশগ্রহন করেন ।১৯৭৫ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় জুডিশিয়াল সম্মেলনে এবং ঐ একই বছওে মালয়েশিয়ার  রাজধানী কুয়ালালামপুরে চতুর্থ  কমনওয়েলথ ম্যাজিস্ট্রেট সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বরে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

অবসরজীবনে তিনি স্মৃতিচারণমূলক একটি পুসিত্মকা রচনা করেন।তিনি ইংরেজীতে লিখেছেন ‘‘অ্যাট বঙ্গভবন লাস্ট ফেজ’’ নামে। ক্ষুদ্রকলেবরের পুসিত্মকাটি সমাপ্ত হয়েছে ৩৭ পৃষ্ঠায়।

তিনি ভূয়োদর্শী মানুষ। বৃটিশের শাসন, পাকিসত্মানীদের শাসন ও শোষণ, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর রাজনৈতিক অরাজকতা সবই প্রত্যক্ষ করেছেন।

১৯৯৭ সালের প্রথমার্ধে তিনি রোগশয্যায় শায়িত হন এবং রোগযন্ত্রণায় কষ্টভোগ করেন। ৬ই এপ্রিলে তিনি সংজ্ঞা হারালে সেই সংজ্ঞা আর ফিরে আসেনি। ৮ই জুলাই সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তিনি ইমেত্মকাল করেন।মৃত্যুকালে আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

কাজী মোহাম্মদ এহিয়া

কাজী মোহাম্মদ এহিয়া ১৯২০সালে রংপুর শহরের মুন্সিপাড়ায় সম্ভ্রামত্ম কাজী পরিবাওে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী মোহাম্মদ সৈয়দ এবং মাতার নাম কামরম্নননেসা বেগম। তিনি তাঁর পিতামাতার পুত্র সমত্মানদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।বেগম রোকেয়ার কিছু পরবর্তী সময়ে তাঁর মা কামরম্নননেসা জন্মগ্রহণ করেন।

কাজী মোহাম্মদ এহিয়া রংপুরের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনের সাথে যুক্ত ছিলেন।কাজী মোহাম্মদ এহিয়ার সর্বাধিক পরিচিতি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে।দেশের রাজনীতির সাথে তাঁর জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।এর রূপায়ন ঘটেছে তাঁর লেখা ‘‘রাজনীতি আমার জীবন’’ গ্রন্থে।গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে।কাজী মোহাম্মদ এহিয়া একজন বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। অভিনয় পারদর্শিতা তাঁকে এনে দেয় যশ ও খ্যাতি।ভাষা  আন্দোলন থেকে স্বাধিকার আন্দোলন এবং স্বাধীনতাযুদ্ধেও তিনি রেখেছেন সক্রিয় ভূমিকা। ২০০৩ সালের ১০ই নভেম্বও তাঁর বর্ণিল কর্মময় জীবনের অবসান হয় ।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৪ বছর।

জানকীবলস্নভ সেন

নীলফামারী জেলার ডিমলার জমিদার ছিলেন রাজা জানকীবলস্নভ সেন। ডিমলার জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা হররাম সেন। রঙ্গপুর কৃষক ও প্রজাবিদ্রোহের (১৭৮০-১৭৮৩) দেবীসিংহের সহকারী হিসেবে হররাম সেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর পক্ষঅবলম্বন করলে কাযিরহাট পরগণার বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং ডিমলায় তাঁর কাচারীবাড়ীও বিদ্রোহী প্রজারা পুড়িয়ে দেয়।

১৯০৮ সালে এক উইল বলে ডিমলা জমিদারীকে তিনি মুজকুরী ও দেবোত্তর এস্টেটে বিভক্ত করেন । দেবোত্তর এস্টেটের জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৬৫ একরসহ বহু অস্থাবর সম্পত্তি। এই রংপুর এমনকি উত্তরবঙ্গে একমাত্র নাটোরের রানী ভবানী ছাড়া এতবড় দেবোত্তর এস্টেট আর কোন জমিদারীতে ছিল না। এই দেবোত্তর এস্টেটের প্রথম সেবায়েত নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাঁর স্ত্রী বৃন্দারানী।রাজা জানকীবলস্নভের মৃত্যুকালে ডিমলা জমিদারীর মোট আয় ছিল ২.৩৮ লক্ষটাকা ও সরকারী জমা ছিল ৩৫ হাজার টাকার উপরে। রাজা জানকীবলস্নভ সেন ১৯১০ সালে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল আনুমানিক ৭৫ বছর।

মুন্সী  ছমির উদ্দিন আহমদ

মুন্সী ছমিরউদ্দিন আহমদ রংপুর শহরের অনতিদূরে ঘাঘট নদীর তীরে অবস্থিত বখতিয়ারপুর গ্রামে ১৮৪৮ সালে (১২৫৫ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহন করেন। তাঁর বংশগত উপাধি ‘‘ বখতিয়ারী’’। তাঁর পিতা ও মাতার নাম জানা যায়নি। তিনি গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রংপুর নর্মাল স্কুলে ভর্তি হন।

ছমিরউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক।সেকালে মুসলিম জাগরণে যে সমসত্ম প্রতিষ্ঠান গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেগুলির মধ্যে‘‘রঙ্গপুর মোহামেডান এসোসিয়েশন’’ ‘‘নুরম্নল ঈমান সমাজ’’ ও ‘‘ইসলাম মিশন’’ উলেস্নখযোগ্য।রংপুরে ‘‘ইসলাম মিশন’’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সাহিত্য ও সংস্কৃতি অনুরাগী মহীপুরের জমিদার খানবাহদুর আবদুল মজিদ চৌধুরী।ইসলাম ধর্মের পাঁচটি সত্মম্ভ কলেমা, নামাজ,রোজা ,হজ্জ ও যাকাত সর্ম্পকে উলেস্নখযোগ্য যে গ্রন্থটি লেখক রচনা করেন সেটির নাম ‘‘মোহাম্মদীয় ধর্ম সোপান’’ (১ম ও ২য় খন্ড) ।এই গ্রন্থের প্রকাশকাল ১৯০২ সাল।লেখকের ‘ইসলাম ইতিবৃত্ত সোপান’ রচিত গ্রন্থরাজীর মধ্যে সর্বাধিক উলেস্নখযোগ্য।

মৃত্যুর পূর্বে তিনবছর পর্যমত্ম হাঁপানী রোগে তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। ১৯২৪ সালে (১৩৩১ বঙ্গাব্দে) রংপুর শহরের রাধাবলস্নভের নিজ বাসভবনে তিনি হজ্জ্বের দিনে ইমেত্মকাল করেন।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর।

তসলিমুদ্দিন আহমদ

তসলিমুদ্দিন আহমদ ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে  এপ্রিল (১২৫৯) লবঙ্গাব্দের ১৯ শে বৈশাখ  জন্মগ্রহন করেন।তাঁর পৈত্রিক নিবাস অবিভক্ত বাংলার জলপাইগুড়ি জেলা বর্তমানে বাংলাদেমের পঞ্চগড়জেলারবোদা থানার অমত্মর্গত চন্দনবাড়ী গ্রাম। তাঁর জন্ম হয়েছে চন্দনবাড়ী  গ্রামে নয়, পিতার কর্মস্থল দার্জিলিং শহরে। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মুহম্মদ তরিকুল।লাহ। তাঁর মাতার নাম জানা যায়নি।

তসলিমুদ্দিন আহমদ একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। নিজ গ্রাম চন্দনবাড়ী মডেল স্কুলে তাঁর  প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়।সেই স্কুলথেকে বৃত্তিসহ রংপুর পিলা স্কুলে ভর্তি হন।১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে এই স্কুলথেকে কৃতিত্বেও সঙ্গে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায়  উত্তীর্ণ হন। তিনি উচ্চশিক্ষা  অর্জনের জন্যে কলকাতায় গমন করেন।কলকাতা থেকে তিনি আই এ ,বি এ এবং বি এল পাস করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নঈমউদ্দিন নেসা।তসলিমুদ্দিন আহমদ ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পরবর্তী বছওে (১৮৮৩) প্রথমে পূর্ণিয়া, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি শহরে ওকালতি আরম্ভ করেন।উচ্চশিক্ষাঅর্জনের জন্য কলকাতায় অবস্থানকালে কলেজ জীবনেও তসলিমউদ্দিন আহমদ আকৃষ্ট হন সাহিত্যচর্চায়।সে সময়ে তাঁরা কয়েক বনধু মিলে ‘‘ইসলাম ’’নাম  দিয়ে একটি মাসিক পত্রিকা প্রচার  করেন।‘‘নবনূর’’ পত্রিকায় তিনি তফসিরসহ কুরআনের কয়েকটি সুরার বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেন।শুধু  সাহিত্যসেবক হিসেবেই নয় একজন সমাজসেবক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান ছিলেন।রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষৎ গঠনের উদ্দেশ্য ছিল: প্রত্নতাত্তিক নির্দশন ও পুরাতাত্তিবক নির্দশন আবিষ্কার, ভাষা সর্ম্পকে গবেষণা ,কৃষ্টি ও শিল্পকলার চর্চা প্রভৃতি।

রঙ্গপুর নুরম্নল ঈমান জামায়াতের সঙ্গে তসলিমুদ্দীন আহমদের সর্ম্পক ছিল অত্যমত্ম ঘনিষ্ঠ।১৯১২ সালে তাঁকে খানবাহাদুর উপাধীতে ভুষিত করে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ শে মার্চ রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ায় নিজ বাসভবনে তিনি পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।

করিমুন্নেসা খানম

করিমুন্নেসা খানম ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম জহিরম্নদ্দিন মুহম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের।মাতার নাম রাহতন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী।

সামাজিক প্রতিকূল অবস্থা ,নারীশিক্ষার প্রতি অবহেলা ও ঔদাসীন্য এবং রক্ষণশীলতার কারণে করিমুন্নেসা  খানমের প্রতিভা পরিপূর্ণভাবে বিকাশলাভ করতে সক্ষম হয়নি।একদিন গোপনে পুঁথি পড়তে গিয়ে পিতার কাছে হাতেনাতে তিনি ধরা পড়েন।১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে গেলো। সাবেক ময়মনসিংহ জেলার দেলদুয়ারের জমিদারবাড়ীতে আবদুল হাকিম গজনভীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।মাত্র নয় বছর বিবাতিহ জীবনযাপনের পরে দুটি পুত্র সমত্মান রেখে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্বামী ইমেত্মকাল করেন।

করিমুন্নেসা খানম অনেক গুণের অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর বিদ্যাশিক্ষার প্রতি আগ্রহই শুধু নয়, তাঁর সাহিত্যপ্রতিভা্ও উলেস্নখের দাবী রাখে।করিমুন্নেসা স্বভাবকবি ছিলেন । পারিবারিক ঘটনা এবং সামাজিক বিষয়ে অনেক কবিতা লিখিয়াছেন।কিন্তু সে কবিতাগুলি দিনের আলোক দেখিতে পায় নাই।বেনামিতে তাঁর কবিতা সেকালের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।শুধু কবিতাই নয় বেনামীতে সেকালের পুসত্মকও মুদ্রণ সৌভাগ্যলাভ করেছে।তিনি পারস্য ভাষাও জানিতেন।করিমুন্নেসা তাঁর সমকালীন অনেক প্রগতিশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।বেগম রোকেয়া তাঁর বিখ্যাত মতিচুর গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণটি বড় বোন করিমুন্নেসার নামে উৎসর্গ করেন।করিমুন্নেসা খানম চৌধুরানী ১৯২৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইমেত্মকাল করেন।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।

হায়দার আলী চৌধুরী

হায়দার আলী চৌধুরী নামে সর্ব সাধারণ্যে পরিচিতি থাকলেও তাঁর প্রকৃত নাম ছিল আহসানউদ্দিন মুহম্মদ। তিনি ৯ অক্টোবর ১৯২২ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ফুলচৌকী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম ছিল মসীহউদ্দিন মুহম্মদ এবং মাতার নাম ছিল মাইজুন নেসা বিবি।হায়দার আলী চৌধুরী নিজেকে রংপুরের মোগলবংশীয় ষষ্ঠ পুরম্নষ বলে দাবী করেন। বংশ তালিকা অনুযায়ী মুহম্মদ জঙ্গ বাহাদুর উপাধীধারী। কিন্তু সিপাহী বিপস্নবের পর বিধ্বসত্ম এই পরিবারটি চৌধুরী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে অভ্যসত্ম হয়।হায়দার আলী চৌধুরী ছোটবেলা থেকেই দামাল প্রকৃতির ছিলেন।এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর হয়নি।প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও সমসাময়িক বিদ্বান ও বিদ্যানুরাগীদেও মধ্যে তাঁর প্রতিভা ছিল সমাদৃত।হায়দার আলী চৌধুরী পেশাগতভাবে ঐতিহাসিক ছিলেন না। বরং বলা চলে ইতিহাস ছিল তাঁর নেশা। আর এই নেশার জন্য জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন কুন্ডীর জমিদারদের হাফেজখানায়,রংপুরের লুপ্ত ইতিহাস পুনরম্নদ্ধারের কাজে।রংপুরের শত বছরের বিলুপ্ত ইতিহাসকে তিনি পুননির্মাণ করেছেন।হারিয়েছেন একটি পা। একপায়ে ভর করেই তিনি ইতিহাসের সন্ধানে ফিরেছেন ।রংপুরবাসীকে দিয়েছেন অনেক অজানা তথ্য সম্বলিত ‘‘পলাশী’’ যুদ্ধোত্তর আজাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’’-যা হয়তো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নয় তবে ঐতিহ্য আর কিংবদমত্মীর বিস্ময়কর মিশেল।

তিনি ছিলেন বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী।ইতিহাস ছিল তাঁর প্রিয় বিষয় এবং প্রসঙ্গ।হায়দার আলী চৌধুরী রচিত ‘‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’’ গ্রন্থের প্রথম প্রথম প্রকাশ জুন, ১৯৮৭ সাল এবং দ্বিতীয় প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সাল। নিবেদিতপ্রাণ গবেষক, জাতীয় ইতিহাস অনুসন্ধানী হায়দার আলী চৌধুরী আমাদের বিস্মৃত ইতিহাসের একটি অধ্যায় নিয়ে আজীবন কাজ করে গেছেন।ভারত পাকিসত্মান এবং বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিকদেও সঙ্গে ছিল হায়দার আলী চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক। ইংরেজ কর্তৃক লুটতরাজ হওয়ার পরও নবাব নুরউদ্দিন মুহম্মদ বাকের জঙ্গের যে সমসত্ম স্মৃতি তাঁদেও পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে ছিল তা জাতীয় জাদুঘওে দান করে দিয়েছেন তিনি।অথচ এগুলো বিক্রি করে তাঁর কোটিপতি হওয়ার সুযোগ ছিল। সবকিছু উৎসর্গ করেছেন জাতির উদ্দেশ্যে । জাতিকে নিজ ইতিহাস ও ঐতিহ্য সর্ম্পকে সচেতন করার জন্য। সারা জীবনে একটি বই লিখেই তিনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নিজের নাম তুলে দিয়েছেন।তিনি উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন।সদালাপী ও মিষ্টভাষী এ মানুষটি ১৯৯১ সালের ১লা মার্চ তাঁর স্বপ্নময় ফুলচৌকির বাড়ীতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।

ইয়াকুব মাহফুজ আলী (জবরেজ)

ইয়াকুব মাহফুজ আলী ওরফে জররেজ মিয়া রংপুর শহরের মুন্সীপাড়ার এক সম্ভ্রামত্ম মুসলিম পরিবাওে ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা এ.কে.এম মোতাহের আল,, মাতা-আতিকা বেগম এবং পত্নীুসুফিয়া খাতুন ওরফে হোসেনী বেগম (রানু)।দুই ভাই বোনের মধ্যে জররেজ মিয়া প্রথম।অল্পবয়সে পিতৃহীন হন তিনি। অভিভাবক হিসেবে পাশে দাঁড়ান পিতৃব্য আজহার আলী।

প্রাথমিক পড়ালেখা শুরম্ন হলেও পরবর্তীতে উচ্চতর বি.এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি।গতানুগতিক লেখাড়ার গন্ডীতে মেধা ও মননকে আবদ্ধ না রেখে স্বাধীনচেতা মনোভাবের পরিচয়  দেন আইনপড়ার মাধ্যমে। তিনি ১৯৩৫ সালের দিকে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইন পেশায় যুক্ত হন।তবে ছাত্রাবস্থায় তিনি ছাত্র রাজনীতির একজন নামকরা কর্মী  ছিলেন।২৫শে মার্চ বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসের এক কালো দিবস। পাকিসত্মানী হানাদার বাহিনীর জিঘাংসা চরিতার্থ করতে পথম শিকার হন রংপুরের প্রাণপ্রিয় মানুষ জররেজ মিয়া ২৭শে মার্চ সকাল ১১টায় মুন্সীপাড়ার বাসা থেকে হানাদার মিলিটারীরা ধরে  নিয়ে যায় জররেজ মিয়াকে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে।সেখানে তিন চার দিন ধরে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। অত:পর ৩রা এপ্রিল মধ্যরাতে আরো দশজনের সাথে দখিগঞ্জ শ্মশানে গুলি কওে হত্যা করা হয় জররেজ মিয়াকে।তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় শ্মশানের মাটি।মাত্র ১২ দিন আগে উচ্চারিত বাণীর পূর্ণতা এলো শাহাদাতের  পেয়ালা পানে।মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হানাদারবাহিনী নিষ্ঠুরভাবে খুন করলো রংপুরের  দেশপ্রেমিক নেতা জররেজ মিয়াকে।৪ঠা এপ্রিল লাশ আনা হয়।কেরামতিয়া মসজিদ চত্বওে জানাজা শেষে তাঁকে ঐ মসজিদের পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। চিরতরে নির্বাপিত হলো একটি নক্ষত্র

আমাদের অমত্মরে শ্রদ্ধা শহীদ জররেজ মিয়ার স্মৃতির উদ্দেশ্যে । তাঁর এই মহান ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই স্বাধীনতা।তাঁর মহান আত্মত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রংপুর পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান  মোহাম্মদ আফজাল (১৯৮৬)সাল ও পৌর পরিষদ রংপুরের প্রধান একটি সড়কের অংশ(ডিসির বাসভবন থেকে রামমোহন ক্লাব পর্যন্ত) তাঁর নামে নামকরণ করেন। তাছাড়াও তাঁর নামে একটি মার্কেটের নাম রাখা হয়েছে।আজো তাঁর কথা রংপুরের মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তাঁর স্মৃতিকে চিরস্মরনীয় করে রাখার ব্যাপারে আজকের প্রজন্মের আমত্মরিকতা নিয়ে  এগিয়ে আসা দরকার।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৭ বছর।

শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জি

শিবেন্দ্রনাথ মুখার্জি কারো কাছে শিবেন দা, কারো কাছে শিবেন অথবা সংক্ষেপে শিবেন মুর্খাজি নামে অধিক পরিচিত।তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৫ সালে (৫জ্যেষ্ঠ ১৩৩২ বঙ্গাব্দ) মালদহ শহরে।তাঁর পিতার নাম হরনাথ মুখার্জি। তাঁর পিতা ছিলেন পেশায় একজন সরকারী ডাক্তার।শিবেন মুখার্জির বাল্যশিক্ষার সূত্রপাত রংপুরেই। ১৯৩৪ সালে রংপুর  জিলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণীতে  অধ্যয়নকালেই তিনি ইংরেজ রাজত্বের বিরম্নদ্ধে বিপস্নবে অংশগ্রহণ করেন।বার বছর বয়সে ১৯৩৭ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন।কারমাইকেল কলেজ থেকে বি.এ পাশ করার পর শিবেন মুখার্জি কলকাতায় চলে যান উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করতে। কলকাতায় এম.এ ও আইন পড়ার সময় থেকেই শিবেন মুখার্জি বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন।

শিবেন মুখার্জি কলকাতায় ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সেখানে ১৯৩৮ সালে ছাত্র ফেডারেশন গঠিত হয়।শিবেন মুখার্জি সাংবাদিকতা কোর্স সমাপ্ত কওে সাংবাদিক জীবন শুরম্ন করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শিবেন মুখার্জির ভূমিকা ছিল অত্যমত্ম সক্রিয়। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক।১৯৫৩ সালে রংপুর মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে এই মহান নেতা শিবেন মুখার্জিকে মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার নির্বাচিত করে সম্মানিত করেন ১৯৫৫ নালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের সময় শিবেন  মুখার্জির পাসপোর্ট বাতিল করা হয় এবং বিনা বিচারে তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়।১৯৫৬ সালে দুবছর কারাভোগের পর তিনি মুক্তিলাভ করেন।

শিবেন মুখার্জি ছিলেন একজন প্রাণবমত্ম নাট্যব্যক্তিত্ব।শিখা সংসদ নাট্যদলের সঙ্গে অন্যতম প্রধান সংগঠক হিসেবে শিবেন মুখার্জি অংশগ্রহণ করতেন উক্ত নাট্যউৎসবে।১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ শুরম্ন হলে শিবেন মুখার্জি আবারও কারারম্নদ্ধ হন।১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরম্ন হলে ৩০ মার্চ বর্বও পাকিসত্মানি সেনারা শিবেন মুখার্জিকে রংপুরস্থ গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে।

শিবেন মুখার্জি ছিলেন চিরকুমার ,সদালাপী, সমাজসংস্কারক, কমিউনিস্ট ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির বলিষ্ঠ ও একনিষ্ঠ কর্মী, সাহিত্যিক ,নাট্যকর্মী, নাট্যজগতের ঘোষক ,উপদেষ্টা,পরিচালক,সুনিপুন ও দক্ষ সমাজ সংগঠক ,সাংবাদিক, আইনজীবী ,রাজনীতিবিদ সর্বোপরি একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বাংলার গৌরব।সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে নির্মম ও নির্দয়ভাবে সারিবদ্ধ অবস্থায় অনেক দেশপ্রেমিক ,স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষদের সাথে তাঁকেও পাকিসত্মানী নরঘাতকেরা গুলি করে হত্যা করে।অসংখ্য দেশপ্রেমিক চলে গেলেন, সাথে শিবেন মুখার্জিও । মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৬ বছর।

মোহাম্মদ ইউনুস

মোহাম্মদ ইউনুস ১৯৪১ সালের ১লা জুন তারিখে রংপুর জেলার বদরগঞ্জ  উপজেলার কুতুবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার     নাম মোঃ বাহারউদ্দিন।গ্রামের স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন।১৯৫২ সালে রপু জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে তিনি ভর্তি  হন এবং এই স্কুল থেকে ১৯৫৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্সায় তিনি উত্তীর্ন হন।১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে তিনি আই,এ পরীক্ষফায়   প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে অর্থনীতিতে সম্মান দ্বিতীয় শ্রেণী এবং  ১৯৬২ সালে অর্থনীতি বিষয়ে এম,এ পরীক্ষাায় দ্বিতীয় শ্রেণী অর্জন করেন।১৯৬৩  সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে তিনি  যোগদান করেন।১৯৯৭ সালে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন।মৃত্যু পূবেৃ তিনি ঐপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

শিক্ষা ও সংস্কৃতি সচেতন মোহাম্মদ ইউনুস অধ্যাপনার পাশাপাশি সামাজিক নানাবিধ কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত     রেখেছিলেন।১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির তিনি ছিলেন সাধারন সম্পাদক।১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যমত্ম তিনি সিন্ডিকেট সদস্য এবং ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সিনেট সদস্য ছিলেন।১৯৯৬ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অর্থনীতি বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।১৯৯৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির পদ তিনি অলংকৃত করেছিলেন। ২০০২ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যমত্ম বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাহী কমিটির তিনি অন্যতম সহ-সভাপতি ছিলেন।২০০৪ সালে ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার তিনি ছিলেন সভাপতি।গ্রন্থ অধ্যয়নের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আকর্ষণ।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক।বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২০০৪ সালে ২৪শে ডিসেম্বর ভোএেকদল ঘাতক অকস্মাত তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।তাঁর লাশ রাস্তাায় ফেলে রেখে হত্যাকারীরা বীরদর্পে সরে পড়ে।বর্বরোচিত খবর জানাজানি হবার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমগ্র রাজশাহী শহর বিক্ষোভে  উত্তাল হয়ে ওঠে।৩০শে ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয় রাজশাহী শহরে।স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাতে নিহত হয়েছেন  মোহাম্মদ ইউনুস।

মোহাম্মদ ইউনুস ছিলেন নীতিবান ও আর্দশনিষ্ঠ মানুষ। গভীর আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে শিক্ষাদানের পাশাপাশি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন।মোহাম্মদ ইউনুস একজন গবেষক ও লেখক ছিলেন।জার্নাল অব দি আই.বি.এস.‘‘বাংলাদেশ ইকোনমিক স্টাডিজ’’ , ‘‘দ্য বাংলাদেশ একাউন্ট্যন্ট’’ প্রভৃতি পত্রিকায় অর্থনীতি বিষয়ক গবেষণামূলক নিবন্ধাদি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।

মৃত্যুকালে মোহাম্মদ ইউনুস স্ত্রী ,এক পুত্র, এক কন্যা, আত্নীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ও অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

 খোন্দকার  মুখতার ইলাহী

খোন্দকার মুখতার ইলাহী ১৯৪৯ সালের ২৬শে মার্চ রংপুর শহরের ধাপে এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষাাবিদ পরিবাওে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর       ডাকনাম চিনু। তাঁর পিতার নাম  খোন্দকার দাদ ইলাহী ও মাতার নাম মরিয়ম খানম।খোন্দকার দাদ ইলাহীর আদি পিতৃভূমি মাগুরা জেলা চাকুরীসূত্রে রংপুর শহরে তিনি বসতি স্থাপন করেন।সরকারি চাকুরিতে নিয়োজিত থেকে তিনি রেঞ্জ স্কুল পরিদর্শক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।এরপর তিনি কেরামতিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং মাহিগঞ্জস্থ আফানুলস্নাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।কারমাইকেল  কলেজ থেকে তিনি আই,এ পাশ করেন।এরপর তিনি ইংরেজী অনার্সে ভর্তি হন।তিনি রাজনীতিতে জড়িত হয়ে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে শুরু হয়  অসহযোগ আন্দোলন। ৩রা মার্চ তারিখে কারমাইকেল কলেজের ছাত্র সংসদেও আহবানে মুখতাইেলাহীরনেতৃত্বে একটি বিমাল মিছিল রংপুর শহর প্রদক্ষিণে বের হয়।৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরিপ্রেক্ষিতে মুখতার ইলাহী ও তাঁর  কর্মীবাহিনী গ্রামে গ্রামে এক ব্যাপক প্রতিরোধ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে শুরু করেন।২০শে মার্চের পর থেকে রংপুর শহরের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। মুখতার ইলাহীর নেতৃত্বে ছাত্রকর্মীদের  মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে থাকে

এক সময়ে রংপুর শহরের কেন্দ্রে তৎকালীন মর্ডাণ সিনেমা হল চিল হানাদারবাহিনীর একটি প্রধান নির্যাতনকেন্দ্র।মুখতার ইলাহী   ১৯৭১ সারের আগস্ট মাস থেকে এই নির্যাতনকেন্দ্র আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।এজন্য তিনি একটি বিশেষ গেরিলা গ্রুপ তৈরি করেন।অপর একটি ÿুদ্র দলসহ অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ নিয়ে ১৯৭১ সারের ৮ই নভেম্বও সাহেবগঞ্জথেকে লালমনিরহাট হয়ে তিনি রওনা হন রংপুরের পথে।

১৯৭১  সালের ৯ই নভেম্বর ।এক মোকাবহ দিন।মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও এক স্মরণীয় দিন।মুখতার ইলাহী ও অজ্ঞাতপরিচয় বালক যোদ্ধাসহ ৫৪ জন মুক্তিকামী গ্রামবাসীকে হানাদারবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে।পরে গ্রামবাসীরা শহীদদের লাশ আড়াইখামার ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে দাফন করেন।এর একমাস পর মুখতার ইলাহীর ‘‘মুজিববাহিনী’’ ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদল মুক্ত করেন রংপুর শহর।মৃত্যুকারে শহীদ মুখতার ইলাহীর বয়স হয়েছিল মাত্র ২২ বছর।

নুরুল ইসলাম

নুরুল ইসলাম ১৯৩৩ সালের ১৮ই আগস্টে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পিয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম বখতার হোসেন ও মাতার নাম রমিছা খাতুন ।তিনি বৈরাতী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করেন।এরপর তিনি গাইবান্ধা ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হয়ে তিনি ১৯৫২ সালে আই,এ এবং১৯৫৫ সালে তিনি রাজশাহী কারাগার থেকে বি,এ পাশ করেন।তিনি ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে এম,এ এবং১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা  ও সাহিত্যে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি দৈনিক মিলস্নাত,দৈনিক ইত্তেফাক ,সাপ্তাহিক ধূমকেতু ও মাসিক সওগাত পত্রিকায় সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হন। ১৯৫৯ সালে বরিশালের চাখার ফজলুল হক কলেজে বাংলাবিভাগের প্রভাষক হিসেবে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন।১৯৬২  সালে কারমাইকেল কলেজে (বেসরকারী) বাংলাবিভাগের প্রভাষক হিসেবে তিনি সরকারী কলেজে পরিণত হয়। ১৯৬৩ সালে বেসরকারী কলেজ হিসেবে রপু কলেজ গড়ে উঠলে সেই কলেজের বাংলা বিভাগে  প্রভাষক পদে তিনি যোগদান করেন।১৯৯০সালে এই কলেজ থেকে বাংলাবিভাগীয় প্রধান হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।তিনি মৃত্যুর পূর্ব পযন্ত রংপুর আইন মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় এবং আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

তিনি ছিলেন রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিত্ব। ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন।কারমাইকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন।ভাষা আন্দোলন চলাকালে তাঁর রচিত ও নিজকন্ঠে পরিবেশিত সঙ্গীত-

মোরা বন্ধন মানিনা

শৃঙ্খল মানিনা

চাই অধিকার

এই গণসঙ্গীত ছাত্র জনতার মধ্যে ব্যাপক সাড়া সৃষ্টি করেছে।সাহিত্যচর্চায় বর্তী হয়ে তিনি প্রবন্ধ ,ফিচার,গীতিনকশা  ও নাটক রচনা করেছেন।মহফিল হকের সথে যৌথ সম্পাদনায়  তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ এবং রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থেও তিনি অন্যতম সম্পাদক ছিলেন।

শিক্ষাকক্ষত্রেও তিনি অবদান রেখেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, রংপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন।রংপুরের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।শিক্ষা ,সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চার জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।১৯৮৪ সালে সমবায় কার্যক্রমে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদক ও জাতীয় পুরস্কার এবং ১৯৮৮ সালে  শ্রেষ্ঠ শিক্ষা হিসেবে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি পুরস্কৃত হন।১৯৮৪-১৯৮৫ অর্থ বছরে ঋণ আদায়ে প্রশংসনীয় কাজের জন্য বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন।২০০২ সালে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলকক্ষ অন্যতম ভাষাসৈনিক হিসেবে তিনি সংবর্ধিত হন।তিনি ২০০৬ সালে সাহিত্যে রাষ্টীয় পুরষ্কার ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

তিনি ২০০৫ সালের ৩১শে জানুয়ারীতে ঢাকায় ইনন্তকাল করেন।মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।

মহেশচন্দ্র রায়

মহেশচন্দ্র রায় রংপুর জেলার নীলফামারী মহকুমার কিশোরগঞ্জ থানার অধীন পুটিমারী গ্রামে ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ১৯শে মাঘ তপশীল শ্রেণীভুক্ত রাজবংশী  বংশে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতার নাম বাবুরাম রায় ও মাতার  নাম বিমলারাণী রায়।মহেশচন্দ্রের জন্মের পাঁচ মাস পরেই তাঁর মা পরলোকগমন করেন।তাঁর বাবা ছিলেন একজন ভাল গাইয়ে।সংগীতসাধনায় মহেশচন্দ্রের দীক্ষাগুরু তাঁর পিতা বাবুরাম রায়। পিতার হাত ধরেই সংগীত জগতে তাঁর প্রবেশাধীকার ঘটে।পাঁচ ছয় বছর বয়সে মহেশচন্দ্র গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হন।সেখান  থেকে তিন বছরের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কিশোরগঞ্জ ইংরেজী কলেজে তিনি ভর্তি হন।প্রায় এগারো বছর বয়সে তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেন।

নাট্যাভিয়নয়ে অংশগ্রহন করে তিনি রৌপ্যপদক লাভ করেন।সুমধুর কন্ঠের অধিকারী মহেশচন্দ্র।গ্রামে যাত্রা ,সংকীর্তন প্রভৃতি দলে তিনি যোগদান করেন।ধীরে ধীরে তাঁর কন্ঠে পূর্ণতা আসছে, সংগীতসাধনায় আসছে গভীরতা তাঁর সুনামও ছড়াচ্ছে দ্রুততার সাথে ।একসময়ে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম জীবনের কবিতার কিছু অংশ-

যদি প্রাসাদ বলে আমি বড়

আমি মহান অতি

ইট বলে কিসের বড়

যদিমোরাই ভেঙ্গে পড়ি।

তেমনি যদি ইটও বলে

মোদের সমান কে?

গর্ব তাদের খর্ব হবে

ধূলিকণা পড়ে যদি ঝরে।

মানুষের মাঝে মানুষ ওরাই

যাদের করেছ ছোট

ত্যাগের মহান আর্দশে গড়া

তাই সকলের বড়।

দ্রুতগতিতে তাঁর ভায়াইয়া গানের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছিল।‘‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’’,‘‘নদী না যাইওরে বৈদ’’-এ সমসত্ম গানের সুর কিশোর মহেশচন্দ্রের হৃদয় তোলপাড় করে।তাঁর সুরেলাকন্ঠের দরদী গান কত শত মানুষের হৃদয় আলোড়িত করেছে তার হিসেবদেওয়া সম্ভবপর নয়।মহেশচন্দ্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুঁথি সংগ্রহ করতেন।একসময় তাঁর পুঁথির ভান্ডার হলো পরিপূর্ণ।সংগৃহীত পুঁথির স্ত্তপ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধচলাকালে হারিয়ে তিনি হয়ে পড়েন দিশেহারা।

তাঁর লেখা অসংখ্য গান প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।তিনি রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ভাওয়াইয়া গান ও কবিতা লেখা শুরু করেন।একাধারে গীতিকার ,সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।তিনি রংপুর বেতারকেন্দ্রে সঙ্গীত পরিবেশন করতেন । রংপুর বেতারকেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন তিনি।১৯৮৬সালে রংপুরে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।

মহেশচন্দ্র রায় ছিলেন জনদরদী।মহেশচন্দ্র রায় ১৩৯৯ বঙ্গাব্দের ১৬ই মাঘ পরলোকগমন করেন।১৯৯৩ সালের ২রা সেপ্টেম্বরে তাঁর রচিত ‘‘ধীরে বোলাও গাড়ি’’ নামে একটি গানের বই নীলফামারী শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে।

মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।

ফজলুল রহমান চৌধুরী

নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার বর্ধিষ্ণু বগুলাগাড়ী গ্রামে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফজলূল রহমান চৌধুরী।জলঢাকার জমিদার পরিবারের আছে গৌরবময় ইতিহাস।মমিন উদ্দিন চৌধুরীর পূর্বপুরুষ ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সেনাবাহিনীর এক সৈনিক।১৯১৯ সালে নীলফামারী হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হন।এরপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন সু-সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী।তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।উভয়েই ছিলেন রবীন্দ্রঅনুরাগী।সৈয়দ মুজতবা আলীর ন্যায় তিনিও শান্তিনিকেতনে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।১৯২৪ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি বি.এ.পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।

১৯২৫সালে লহপ্রিলিমিনারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে জমিদারী দেখাশুনা শুরু করেন।গ্রীষ্মকালের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটাতেন দাজিলিং ও শিলিগুগিতে।কলেজে পড়াকালীন ফজলুর রহমান চৌধুরী লেখালেখির জগতেতে প্রবেশ করেন।কলকাতা থেকে প্রকাশিত ততকালীন বিখ্যাত পত্রিকা ‌‍‍প্রবাসী, ভারতবর্ষ,মাসিক বসুমতীতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হত।জীবিকার জন্য লেখা বা অন্যকোন পেশা গ্রহণ করার প্রয়োজনও তাঁর ছিল না।তাঁর পাঠস্পৃহা ছিল প্রবল।তাঁর ছিল বিপুল দেশীবিদেশী বইয়ের সংগ্রহ।রীতিমত একটি আলাদা গ্রন্থাগার।অনেক বই নীলফামারীর একটি ক্লাবে দান করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম ও গায়ক আব্বাসউদ্দীনের সাথেও ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠতা।তিনি কিছুদিন শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভ করেন।রবীন্দ্রনাথের নিজ হাতে লেখা‍‌‍‍ তোমার বাঁধন খুলতে লাগে বেদন কি যেচ গানটি তাঁর ডায়েরীতে লেখা ছিল।

তিনি সংগীতের চর্চা করতেন।১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে জলপাইগুড়ি জেলার বিখ্যাত টি ফ্যামিলির সুকন্যা তাজুননাহার বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে তিনি আবদ্ধ হন।বাংলাদেশ ভূখন্ডে মুসলমান লেখকদের মধ্যে পবিত্র কুরআন শরীফ পূর্ণাঙ্গ অনুবাদের কৃতিত্ব সর্বপ্রথম তিনি দাবিদার।

ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতা ছিল তাঁর সাহিত্যচর্চার কেন্দ্রস্থল। ভারতবর্ষ ও বসুমতী সাহিত্যপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গল্প,কবিতা।তাঁর লেখা গল্প ও কবিতাগুলো সংকলিত হয়েছে রচনা সংকলন নামের পান্ডুলিপিতে।তাঁর লেখা যে কটি কবিতা পাওয়া গেছে সেগুলেআর নাম নূপর,শরতে,দুটি আঁখি,মরণে ,চকিতা,বাঁধনহারা, বেদনায় বিয়োগে, শেষের দিনে এছাড়াও রচনা সংকলনের প্রথম কবিতা নূপুর এবং শেষ কবিতা দূরের সুর।

কবির কবিতাগুলো প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত-প্রম,প্রকৃতি ও দুঃখানুভূতি ।প্রিয়তমের কাছে অন্তিমশয্যায় মমতাজের শেষ প্রার্থনা ভাবে, ভাষায় ও ছন্দে মনোরম।কবি ফজলুর রহমান চৌধুরী ১৯৬১ সালে পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।

 

তথ্য সূত্র :
রংপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব : সম্পাদিত, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ
তুমি আমাদেরই লোক : সম্পাদিত, কামরান শাহ্‌ আব্দুল আউয়াল স্মারক গ্রন্থ।